মোটা দাগে সুন্দরবনের শত্রূ-মিত্র এবং বন রক্ষার বিভিন্ন দিক!


শত্রু মিত্র অচিহ্নিত রেখে সুন্দরবন রক্ষার আংশিক কর্ম পরিকল্পনা, রাজনৈতিক আন্দোলন না করে শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে আংশিক কর্ম তৎপরতা কোনই কাজে আসবে না। কেন? বটম লাইন গুলো উল্লেখ করাই এই আলোচনায় ঢুকার প্রয়াস। 
সুন্দরবনের শত্রূঃ 
১। স্যালাইন পেনিট্রেশনঃ 
১ক। ফারাক্কা বাঁধঃ
 ১৯৭৪-৭৫ এ পরীক্ষা মূলক এবং স্থায়ীভাবে চালুর দিন থেকেই শুষ্ক মৌসুমে সাধু পানির হঠাত এবং একচেটিয়া প্রত্যাহারের কারনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বড় আকারে সাগরের লোনা পানির আগ্রাসন শুরু হয়, এতে করে প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনে সাধু এবং লবনাক্ত পানির আসা যাওয়ার মিথস্ক্রিয়া নস্ট হতে শুরু করে। একদিকে নদীর সাধু পানির উচ্চতা এবং চাপ হ্রাস পায় অন্যদিকে লোনা পানি স্থল ভাগের অভ্যন্তরে বহু দূর পর্যন্ত প্রবেশ করে (স্যালাইন পেনিট্রেশন)। 

১খ। ভারতীয় বাঁধ এবং পানি প্রত্যাহার ব্যবস্থাপনাঃ
সময়ের সাথে গঙ্গা সহ অন্য ৫৩ টি অভিন্ন এবং আন্তর্জাতিক নদী শাখা নদী এবং কানেক্টেড খাল গুলোতে ভারত বাঁধ এবং পানি প্রত্যাহার ব্যবস্থাপনা এগিয়ে নেয়ার সাথে সাথে স্যালাইন পেনিট্রেশন শুধু বেড়েছেই। 

১গ। গঙ্গা- কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পঃ 
কৃষির জন্য অত্যন্ত ভালো পদক্ষেপ হলেও শুকনা মৌসুমে গঙ্গার অবশিষ্ট সামান্য পানির উল্লেখযোগ্য আবারো সেচ প্রকল্পে পুনসঞ্চালন শুর হলে স্যালাইন পেনিট্রেশন আরো বাড়তে শুরু করে। 

২। সাধু পানির প্রবাহে ভয়াবহ দূষণ এবং ভারী ধাতুর বিপর্যয়কর উপস্থিতিঃ 
ভয়ঙ্কর ভারী ধাতুর সাধু পানি ম্যানগ্রোভে কি কি সমস্যা তৈরি করছে তা গবেষণার দাবি রাখে
মাত্রাতিকরিক্ত স্যালাইন পেনিট্রেশনের কারনে সুন্দরবনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুল এমনিতেই দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমে হাফিয়ে উঠে এবং বর্ষায় নদীর সাধু পানির উচ্চতা বাড়লে কিছুটা দম নেয়! তার উপর পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নদ-নদীর জলজ এবং বনের উদ্ভিজ্জ বাস্তুসংস্থানের ওপর মারাত্মক প্রভাবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
ভারত এবং বাংলাদেশের শিল্প, শহুরে এবং হিউম্যান ওয়েস্ট এর কারনে সৃষ্ট ভয়ঙ্কর পানি দূষণে নদীতে শত গুণ বেশি ভারি ধাতুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। সুন্দরবনে ব্যাপক হারে গাছ গাছালি বিভিন্ন রোগ আক্রান্ত (আগা মরা সহ) যা এর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে পায়রা নদীতে ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম ও সিসা রয়েছে যথাক্রমে ৪৫, ১২, দশমিক ৭২ ও ২৫ মিলিগ্রাম। করতোয়ায় ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম ও সিসার মাত্রা যথাক্রমে ১০৯, ২৫, ১ দশমিক ২ ও ৫৮ মিলিগ্রাম। পদ্মা নদীতে ক্রোমিয়াম রয়েছে ৯৭ ও সিসা ১৭ মিলিগ্রাম।

উল্লেখ্য পরিবেশ অধিদপ্তর সুপেয় পানিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও সিসার মানমাত্রা নির্ধারণ করেছে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রাম। আর ক্যাডমিয়ামের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা নির্ধারণ করেছে দশমিক শূন্য শূন্য ৫ মিলিগ্রাম। অথচ এর বহুগুণ বেশি (১০০ গুণের বেশি) রয়েছে বাংলাদেশের সুপেয় পানির সবচেয়ে বড় উত্স নদীগুলোয়। আর শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিশোধনের পর নির্গত তরলের ক্ষেত্রে আর্সেনিকের মাত্রা দশমিক শূন্য ৫, ক্রোমিয়াম ১, ক্যাডমিয়াম দশমিক ৫ ও সিসার মানমাত্রা ১ মিলিগ্রািম নির্ধারণ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া সেচভূমির জন্য সিসার গ্রহণযোগ্য মাত্রা দশমিক ১, ক্রোমিয়ামের ১, ক্যাডমিয়ামের দশমিক ৫ ও আর্সেনিকের দশমিক ২ মিলিগ্রাম। কিন্তু অধিকাংশ নদ-নদীর পানিতেই এসব ধাতুর উপস্থিতি নির্ধারিত মাত্রার অনেক বেশি ।
সামনের দিনে আরো ভয়ঙ্কর দূষণের মুখে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছ গুলো কি কি রোগে আক্রান্ত হবে তা গবেষণার দাবি রাখে। যতই গাছ মরছে, ততই বাড়ছে লূটেরাদের ফরেস্ট পেনিট্রেশন! 

৩। পাঁচ তারা লূটেরা চক্রঃ *ঢাকার মাফিয়া-*স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতি বাজ, *দুর্নিতিবাজ প্রশাসন- *বনজীবিদের লোভী অংশ এবং *সুন্দরবনের স্থানীয় দস্যু চক্র গুলোঃ বাঘ সুন্দরবনের খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করায় এই পাঁচ শ্রেণীর লূটেরা সবসময়ই বাঘ মেরে সুন্দরবনে মানব পেনিট্রেশন সহজ করতে চেয়েছে। এতে করে বাঘের চামড়া পাচারকারী সময়ে সময়ে বাঘ মেরেছে, হরিণ শিকারি যখন তখন নিরীহ হরিণ মেরে মিট এবং লেদার পাচার করেছে, লোভী মৌয়ালরা (বংশ পরম্পরায় নয়) বেশি মৌচাক কেটেছে (নৌকার দাগ দেয়া অংশের পানিতে ডুবার মত দুর্ণিতি সহায়ক ব্যবস্থার সুবাদে), জেলে বেশি মাছ এবং রেণু আহরণ করেছে, কাঠুরে বেশি কাঠ কেটেছে এবং দস্যুরা পাচার করেছে। বনবিভাগের লোকেরা প্রতিটি ক্ষেত্রে বখরা পেয়েছে, খুলনা বরিশাল বিভাগের/ সিটির নেতারা সরাসরি এই লূটেরা ব্যবসা গুলো ওউন করেছে। 

বাঘ হত্যার পিছনের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা
এই পাঁচ তারা চক্রের উচ্চ ধাপে যেহেতু মেয়র সহ বৃহত্তর খুলনা এবং বরিশাল বিভাগের রাজনৈতিক দলের নেতারা রয়েছে, তাই তাদের আইডেন্টিফাইড না রেখে সুন্দরবন রক্ষার কোন প্রচেস্টা কাজে আসবে না। চোর তারাই, তারাই বনে আগুন দিয়ে পরিষ্কার করে ধানের জমি এবং আবাসন ব্যবসা চালাচ্ছে। 

এই দুর্বিনীত মাফিয়া দস্যূ চক্র চিহ্নিত না করে, শাস্তি না দিয়ে, রাজনৈতিক এবং আইনগত দিক থেকে প্রতিহত না করে কিংবা একই রাজনৈতিক বলয়ে তাদের উপস্থিতির কারনে রাজনৈতিক আন্দোলনে না গিয়ে রাজধানী কেন্দ্রিক সামাজিকপদক্ষেপে সুন্দরবন টিকানো যাবে না। 

চিংড়ীর রেণু সংগ্রহ সুন্দরবনের জলজ পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করছে!

৪। চিংড়ীর রেণুঃ সুন্দরবন উপকূলীয় নদ-নদীতে বাগদা চিংড়ির পোনা ও গলদার রেণু আহরণের জন্য অবাধে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ নেট জাল। ক্ষুদ্র ফাঁসযুক্ত এ জাল দিয়ে একটি বাগদা বা গলদা চিংড়ির পোনা ও রেণু সংগ্রহ করতে অন্তত ৪৬২ প্রজাতির মাছের ডিম, পোনা ও প্লাংকটন নষ্ট হয়। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মত্স্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, খুলনার কয়রা ও পাইকগাছাসহ আশপাশে একটি বাগদা পোনা আহরণে ১১৯টি চিংড়ি প্রজাতির পোনা, ৩১২টি জুপ্লাংকটন প্রজাতি ও ৩১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা নষ্ট হয়। এছাড়া সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটসহ অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় একটি পোনা ধরতে গিয়ে ৪৬টি চিংড়ি প্রজাতি, ৩৫টি জুপ্লাংকটন প্রজাতি ও ১১টি সাদা মাছ প্রজাতির পোনা ধ্বংস হচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য ও মত্স্যসম্পদ দুটিই ধ্বংস হচ্ছে। রেণু সংগ্রহে বিষাক্ত ক্যামিক্যাল ব্যবহারের নজিরও রয়েছে। রেণু আহরণ সুন্দরবনে মানুষের প্রবেশ মাত্রাতিরিক্ত করেছে এবং প্রাণী চক্রকে সংকটাপন্ন করেছে। 

চাষ না করে ওয়াইল্ড সোর্স থেকে মধু আহরণ, চাষ না করে মৎস্য আহরণ বা নিধন, পাখি শিকার, সুন্দরবন সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বন থেকে মধু, মোম, চিংড়ী পোনা, বাঘ এবং হরিনের চামড়া, মিট সহ অনেক অনেক উদ্ভিদ্য এবং প্রাণীজ সম্পদ আহরণের ন্যাচারাল এবং প্রাচীন ব্যাপারগুলো আমাদের ওয়াল্ড লাইফ, জৈব বৈচিত্র, মৎস্য প্রজনন এবং পরাগায়নের মত মৌলিক ব্যাপার গুলোকে বিষিয়ে তুলছে।গত ২-৩ দশকে বিশেষ জাল এবং বিষাক্ত ক্যামিক্যাল দিয়ে চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করার প্রাণঘাতী পদ্ধতি সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।


অত্যন্ত ভয়ের কথা হোল, উল্লেখিত পাঁচ চক্রের যার পর নাই অবারিত সম্পদ লুণ্ঠন এবং রেণু সংগ্রহ অব্যহত থাকলে আশে পাশের এলাকায় কোন ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র না থাকলেও শুধু রাজনৈতিক দুর্বিত্তায়িত প্রাণীজ-জলজ-বনজ সম্পদ আহরণ ভিত্তিক অগ্রসরমান ফরেস্ট পেনিট্রেশন এবং এতদসম্পর্কিত অনাচারে এমনিতেই ২০-৩০ বছরের মধ্যে সুন্দরবন হারিয়ে সাধারণ উদ্যান যাবে। 

৫। মংলা বন্দরের রিমেইক এবং কয়লা মাস ট্রান্সপোর্টেশন ভিত্তিক প্রস্তাবিত পায়রা বন্দরঃ 
সুন্দরবন ঘিরে ১৫০ শিল্প প্রকল্প
সুন্দরবন ধংস প্রচেষ্টায় নতুন প্রাণ দিয়েছে মংলা বন্দরের এলপিজি ভিত্তিক রি-মেইক (সরকার রান্নার গ্যাস সরবারহ থেকে সরে এসে বেসরকারি এলপিজির বাজার উন্মুক্ত করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে)। এতদিন বিপিসি এবং ৬টা বেসরকারি কোম্পানি সীমিত আকারে তাদের মংলা এবং চট্রগ্রাম ভিত্তিক নিজস্ব ছোট ছোট এলপিজি টার্মিনালের মধ্যমে আমদানি করছে তবে দেশি কোম্পানি গুলো মংলা ভিত্তিক এল পি জি হাব তৈরির মহা পরিকল্পনায় আছে, বিদেশী LPG giant LAUGFS(Srilanka) এবং TOTAL GAZ (France) ও এই পরিকল্পনায় রয়েছে। এখানে বটম লাইন হচ্ছে মংলায় স্থাপনা যত বাড়বে, সুন্দরবনে পেনিট্রেশন তত বাড়বে এবং নৌ চলাচলের কারনে প্রানীকূলের নাইট লাইফ ততই বিপর্যস্ত হবে। উল্লেখ্য মংলা কোনভাবেই একটি সমদ্রু বন্দর হবার যোগ্যতা রাখে না। অন্যদিকে মূল নৌ রুট গুলো একের পর এক সিল্টেড আপ হয়ে যাবার কারনে এবং বালু তোলা ভিত্তিক অপরিকল্পিত ড্রেজিং এর কারনে নতুন নতুন নৌ রুট তৈরি হচ্ছে, অর্থাৎ অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্য পরিবহন হচ্ছে এতে সুন্দরবনের স্বাভাবিকতা নস্ট হচ্ছে। 

কয়লার মাস ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য পায়রায় নতুন বন্দর পরিকল্পনা সুন্দরবনের জন্য নতুন আঘাত। উপরোল্লিখিত রাজনৈতিক নেতৃত্বে পাঁচ চক্রের লোকেরাই ভূমি দস্যু হিসেবে নতুন করে আবির্ভুত হয়েছে। রামপালে ভয়ংকর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমি অধিগ্রহণ এদের হাতেই। দেখা যাচ্ছে সুন্দরবন ঘিরে ১৫০ শিল্প প্রকল্প! বন এবং পরিবেশ মন্ত্রীকে এই ব্যাপারে সহনীয়ই মনে হচ্ছে কেননা সুন্দরবনের পাশের এলাকার লোক হয়ে দুর্বিত্ত অংশের নেতৃত্বে তিনিও অগ্রসর একজন। 

অর্থাৎ আবাসন এবং কৃষি চাপের পাশাপাশি সুন্দরবনকে এখন ২টি বৃহৎ বন্দরের অনুকূলে গড়ে উঠা শিল্পের চাপও নিতে হবে। 
উল্লেখ্য গলাচিপা নদীর (কুয়াকাটা) পশ্চিমের এলাকাকে সুন্দরবনের প্রাণ বৈচিত্র এবং পাথরঘাটার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন খেত্রের রক্ষা কবচ বিবেচনা করে এই এলাকাকে বিদ্যুৎ এবং বন্দর অবকাঠামো , বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান সম্পর্কিত সম্ভাব্য ক্রস ড্যাম সহ সকল ম্যান মেইড স্থাপনা কিংবা নদী শাসনের বাইরে রাখার দাবি জোরালো করা দরকার। তাই প্রস্তাবিত পায়রা বন্দরকে পায়রার মোহনা থেকে সরিয়ে গলাচিপার মোহনায় স্থানান্তর এর দাবি জানাই। এতে শিল্পের পেনিট্রেশন অবকাঠামো গত ভাবে অনুন্নত বরিশাল-পটুয়াখালি-গলাচিপা-ভোলায় অবারিত হবে। 


৬। ভারতীয় কয়লার সম্ভাব্য বাজার এবং কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে সুন্দরবনের সমূহ ক্ষতি (শব্দ পানি বায়ু co2 so2) সহ যাবতীয় দূষণ, ভারী ধাতু/হাই পারটিক্যাল নিঃসরণ, পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঢেউ, মাস কোল ট্রান্সপোর্টেশন, প্রাণীকুলের নাইট লাইফ ক্ষতিগ্রস্ত করা, বনে ব্যাপক হিউম্যান পেনিট্রেশন ইত্যাদি) করবে তা নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ গবেষক এবং এক্সপার্ট গণ সবাই একমত। বাংলাদেশে অন্য কোন বিষয়ে এত উচ্চ মান গবেষণা এবং ইন্টেলেকচুয়াল মুভ চোখে পড়ে না। সময় সাক্ষী থাকবে যে, বর্তমান সরকার তার নিজ দেশের নাগরিকের এই সব ইন্টেলেকচুয়াল ইফর্টকে অসম্মান করে একটি অস্পষ্ট আর্থিক চুক্তি এবং লোকদেখানো ভূয়া ইটিপীর মাধ্যমে সুন্দরবনেরই একটি সাবেক অংশে প্রাণ এবং পরিবেশের শত্রু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ এই কেন্দ্র দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আরো পূর্বে সরানোর স্কোপ আছে। 
তবে যেহেতু কয়লার মাস ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য সুন্দরবনের একেবারে নিকটস্থ পায়রায় একটি বন্দরই পরিকল্পনা করা হয়েছে, বুঝা যাচ্ছে রামপাল একটি সাক্সেস পাইলট হয়ে উঠলে এখানে আরো বেশি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। 

উল্লেখ্য বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম মাষ্টার প্ল্যান ২০১০ এবং ২০১৬ তে যেসব বিকল্প জ্বলানি ভিত্তিক বিদ্যুতের কথা বলা হয়েছে (এল এন জি, নিউক্লিয়ার, উইন্ড, সোলার) তা দুর্বল এবং অগণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো, দুর্বল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অতি দুর্নিতির কারনে সময়মত প্রস্তুত হবে না, তাই কয়লার উপর একচেটিয়া চাপ আসবে। আর ভয় এটাই যে নিজের ৬৫০০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুতের জন্য ভারতের নিজেরই যেখানে মান্সম্পন্ন কয়লা নেই (মাত্র ৪ টা ভারতীয় খনিতে আমাদের বড় পুকুরিয়ার মানের কয়লা আছে), ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূল হয়ে উঠতে পারে, নিন্ম মানের ভারতীয় কয়লার এক বিশাল বাজার। এটাই হবে সুন্দরবন ধংসের শেষ পেরেক। 


সংক্ষেপে প্রাকৃতিক এবং জলবায়ু জনিত বিপর্যয়ের বাইরে সুন্দরবন ২ ধরনের মহা নির্যাতন ভোগ করছে। একটি রাজনৈতিক ভাবে মটিভেটেড শিল্প এবং লুন্ঠন চক্র, অপরটি ভয়ংকর সব পদ্ধতিতে বনজীবিদের অবারিত সম্পদ আহরণ। 

বন রক্ষার বিভিন্ন দিক 

ক। বনজীবিদের বিকল্প কর্মসংস্থানঃ 

অবারিত প্রাকৃতিক উৎস থেকে অনিয়ন্ত্রিত কৃষি ও মৎস্য সম্পদ আহরণ গ্রামীণ কর্মসংস্থানেরআদিম উপায় হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অনিয়ন্ত্রিত হিউম্যান ইন্টারভেনশন এর কারনে প্রাণ এবং পরিবেশ এর চরম বিপর্জয়ের ঝুকির উপর দাঁড়িয়ে আমাদের আজ কর্মসংস্থানের সেসব মধ্যমকে পুনরায় ভাবনায় আনতে হবে। 
বন বাঁচাতে সবার আগে বনজীবিদের বাঁচাতে হবে।পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ন দেশে কৃষি পন্য উৎপাদন পুরোপুরি প্রকৃতির উপর ছেড়ে না দিয়ে, পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিক চাষাবাদ ভিত্তিক করে তুলে প্রাকৃতিক কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎসগুলোকে রক্ষায় মনোযোগী হতে হবে।
বনজীবিদের বিকল্প কর্মসংস্থান বন বাঁচানোর ১ম পর্যায়।

খ। রাজনৈতিক মাফিয়াদের সনাক্ত করণ, আইনগত ভাবে প্রতিহত করন, এদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে যাওয়া।তবে বনজীবিদের অর্থনৈতিক ভাবে প্রচণ্ড অভাবী কিংবা প্রান্তিক সমাজে রেখে এই পর্যায় ফলদায়ক হবে না। 

গ। ৩য় পর্যায় হোল সকল নৌরুট সরানো, হিউম্যান পেনিট্রেশন (সম্পদ আহরণ হোক কিংবা পর্যটন) রোধ। অতিমাত্রার নিয়ন্ত্রিত পর্যটন বাস্তবায়নের ব্যাপারটা একেবারেই অনালোচিত। আমরা বাঘের আলোকচিত্র চাই না। বাঘের আন ডিস্টারবড, নিরাপদ এবং স্বাভাবিক স্থল এবং জলজ বিচরণ চাই, হরিণের বিস্তারে বনের গাছ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা চাই।

ঘ। ৪র্থ পর্যায় হোল প্রাণঘাতি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা পোর্ট সরানো এবং মংলা বন্দরের প্রধান রুটকে চলাচলের উপযোগী করে সুন্দরবনের ভিতরের জালিকার নদীর অন্য সকল রুটের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করা । অন্যথায় এক থেকে দুই দশকের ব্যবধানে সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকায় বায়ু, শব্দ এবং পানি দূষণে, পানি এবং বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ম্যানগ্রোভ এবং প্রাণী সুরক্ষার লেয়ার গুলো নষ্ট হয়ে পড়বে। বাঘ এই লেয়ারের উচ্চ স্তরে অবস্থান করছে। বাঘ শেষ হলে সুন্দরবন এর সম্পদ লূটে পুটে খাওয়া সহজ হবে।

বাঘ-হরিণ, কুমির-নদী, সুন্দরী-গোলপাতা, বানর-পাখপাখলি এবং অন্য হাজারো প্রাণের আধার ব্যতীত সুন্দরবনের দৃশ্যত কোন মানব মিত্র নেই। সরাসরি দলীয় ব্যানারে সুন্দরবন রক্ষার মেনিফেস্টো দিতে অস্বীকার করা, ভারতের অবৈধ পরিকল্পনার অনুকূলে ইতস্তত করা এবং সুন্দরবনের রক্ষার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে না যাওয়া (সামাজিক আন্দোলন নয়) ক্ষমতা বলয় ও এর জোট এবং এর বাইরে সকল বাম-ডান-মধ্যপন্থী-জাতীয়তাবাদী সকল রাজনৈতিক দল সুন্দরবনের সরাসরি শত্রু এবং বন লুণ্ঠনকারী হিসেবে বিবেচিত। এটাই চরম বাস্তবতা। চারিদিকে জঘন্য সব মানব শত্রু রেখে এই বাস্তবতায় সুন্দরবন কতদিন টিকে, এই আশঙ্কাকে মূখ্য বিবেচ্য করে বন রক্ষার টপ টু বটম সমন্বিত মহা কর্ম পরিকল্পনা চাই (রাষ্ট্রীয়) যার প্রতি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্যমত্ত এবং দৃঢ় অঙ্গীকার থাকবে। 


সুন্দর বন সুন্দর থাকুক, বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা টেকসই হোক! 

Collecte from
http://bit.ly/2b5BeYW

No comments

Powered by Blogger.